এসপ (ঈশপ) এর জীবনী

এসপ (প্রাচীন গ্রিক: জন্ম: খ্রিস্টপূর্ব ৬২০ – খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৪) বিখ্যাত ও প্রাচীন গ্রীক লেখক ছিলেন। খ্রিস্ট-পূর্ব ষষ্ঠ শতকে তিনি পশু-প্রাণীদের ঘিরে অনেকগুলো উপ-কথা বা কল্পকাহিনী মুখে বলার মাধ্যমে অনেকগুলো নীতি-কথা ব্যক্ত করে আধুনিক বিশ্বে অমর হয়ে রয়েছেন। একসময় তিনি থ্রাসে দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করেছিলেন। প্রাণীসম্পর্কীয় চরিত্র, স্থির বিষয়াবলীকে ঘিরে রচিত উপ-কথা ব্যক্ত করে মানবচরিত্রের সমস্যার সমাধান করতে পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছেন। এ উপ-কথাগুলোর সাথে তাঁর নামও যুক্ত হয়ে আছে এবং মৌখিকভাবে দীর্ঘ সময় ধরে প্রবাহিত হচ্ছে। ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর সাধারণ জীবনধারায় এ উপ-কথাগুলোর ভূমিকা অপরিসীম। এছাড়াও বিশ্বসাহিত্য অঙ্গনেও এর জনপ্রিয়তা অসম্ভব আকারে রয়েছে। রহস্যাবৃত চরিত্রের অধিকারী এসপকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ উপ-কথাসাহিত্যিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

গ্রীক ও রোমান লেখকেরা এসপের উপ-কথাগুলোকে গদ্য কিংবা পদ্যে ধারাবাহিকভাবে লিখে গেছেন। তন্মধ্যে, এসপের উপ-কথাগুলো কবি বাব্রিয়াস কর্তৃক হেলেনীয় রোমান সময়কালে ১ম অথবা ২য় শতকে গ্রীক শ্লোকে পুণঃলিখিত হয়। রোমান কবি ফায়েদ্রাস ল্যাটিন ভাষার শ্লোকে ১ম শতকে রচনা করেছেন। বাব্রিয়াসের উপ-কথাগুলোও এসপের নামধারণ করেছে।

আধুনিক ইউরোপে প্রচলিত উপ-কথাগুলো বাইজেন্টাইন সন্ন্যাসী ম্যাক্সিমাস প্ল্যানুডেসের ল্যাটিন সংস্করণ থেকে আহুত। সংস্কৃত ভাষায় পঞ্চতন্ত্র শিরোনামে খ্রীস্ট-পূর্ব ৩য় শতক থেকে খ্রীষ্ট পরবর্তী ৪র্থ শতকের মধ্যে ভারতীয় লেখক বিষ্ণুশর্মা লিখেছেন। পঞ্চতন্ত্র কমপক্ষে ৫০টি ভাষায় দুই শতাধিক সংস্করণে লিখিত হয়েছে।

বাস্তবিক অর্থে জনপ্রিয় গ্রীক উপ-কথা লেখক এসপের জীবন সমন্ধে কোনকিছুই জানা যায়নি বা খুব কমই জানা গেছে। তাঁকে উপ-কথার জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যে-কোন ধরনের তথ্য বিভিন্ন পৌরাণিক উপাখ্যান ও লোকমুখে তাঁর সম্বন্ধে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি খুব সহজেই সাধারণ জনগণের কাছাকাছি চলে এসেছেন এবং নিজস্ব প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা তুলে ধরেছেন বিভিন্ন হাস্য উদ্দীপক ও মজাদার গল্প বলার মাধ্যমে। ইউরোপের উপ-কথাগুলোয় এসপের সৃষ্ট উপ-কথাগুলোকে ঘিরে রচিত হয়েছে। তবে, তাঁর জীবনভিত্তিক তথ্যগুলোর তেমন কোন ভিত্তি নেই।

খুব সম্ভবতঃ খ্রিস্ট-পূর্ব ৬০০ সালে তিনি জীবিত ছিলেন। এসপের জন্মস্থান নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। থ্রেস, ফ্রিজিয়া, এথিওপিয়া, সামোস, এথেন্স এবং সার্দিস – শহরগুলোর প্রত্যেকেই তাঁর জন্মস্থানের সম্মাননার দাবীদার। মনে করা হয় যে, তিনি দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের থ্রেস অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেছেন যা বর্তমান গ্রিস ও তুরস্কের মধ্যবর্তী অংশে অবস্থিত। তিনি জীবনের অধিকাংশ সময়ই এশিয়া মাইনর উপকূলের নিকটবর্তী সামোস দ্বীপে দাসত্বজীবনে আবদ্ধ ছিলেন। সচরাচর জান্থাস নামীয় এক ব্যক্তিকে তাঁর প্রভু হিসেবে মনে করা হয়। দাসজীবন স্বত্ত্বেও তিনি তাঁর প্রভুর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে আবির্ভূত হতেন ও স্বাধীনতা বিষয়ে ব্যাপক আলোচনায় লিপ্ত হতেন। আদালতে তিনি তাঁর সহজাত উপ-কথা বলার দক্ষতা ও বিভিন্ন বিষয়ের যুক্তিসঙ্গতা নিরূপণ করতে পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছেন।

বলা হয়ে থাকে যে, তিনি ফ্রিজিয়া থেকে এসেছেন। এসপ গ্রিক দাস ছিলেন। বিভিন্ন ব্যক্তিকে প্রভু মেনে তাদের সেবা করেছেন। তিনি সামোসের সামিয়ান ইয়াদমন নামীয় এক প্রভুর ক্রীতদাস ছিলেন ও তাঁর কাছ থেকে অবশেষে মুক্তি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি রাজা ক্রোইসাসের দরবার আনীত হন। রাজা ক্রোইসাস এসপের ব্যক্তিত্বের প্রখরতা ও বুদ্ধিমত্তা যাঁচাই করে আশ্চর্যান্বিত হন এবং তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় প্রেরণ করেন। ডেলফি গমনের একপর্যায়ে স্থানীয় পুরোহিতদের নিজস্ব মনগড়া আইনের মাধ্যমে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

বিখ্যাত ইতিহাসবেত্তা হিরোডোটাসও তাঁর হত্যার বিষয়ে কোন কারণ উল্লেখ করেননি। পরবর্তীকালে অনেক লেখকই তাঁর অবজ্ঞাসূচক দৃষ্টিভঙ্গী, ডেলফিতে টাকা ছড়ানো, রৌপ্যনির্মিত পেয়ালা চুরি ইত্যাদি বিষয়াবলী এ হত্যাকাণ্ডে ইন্ধন জুগিয়েছে বলে ধারণা করেছেন।

এসপের উপ-কথা বা এসপিকায় এসপের উপ-কথাগুলোকে সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। এ উপ-কথাগুলো অদ্যাবধি জনপ্রিয় হয়ে আছে ও শিশুদেরকে নৈতিক শিক্ষা দিয়ে থাকে। অনেক গল্প এসপের উপ-কথায় স্থান পেয়েছে। এসপের বিখ্যাত অনেকগুলো উপ-কথার একটি উপ-কথা হচ্ছে খেঁকশিয়াল ও আঙ্গুর। এতে একটি ক্ষুধার্ত খেঁকশিয়াল কিছু পাকা আঙ্গুরের সন্ধান পায়। কিন্তু নাগালের বাইরে থাকায় টক ঘোষণা করে খেঁকশিয়ালটি চলে যেতে বাধ্য হয়। ১৮৭৯ সালে এ উপ-কথার স্থিরচিত্র অঙ্কন করা হয়েছিল। এ নীতি-কথার মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, কোন কিছু আমাদের আয়ত্তের বাইরে থাকলে প্রায়শই তা ঘৃণা বা অবজ্ঞা প্রদর্শন করে চলে যেতে বাধ্য হই। এছাড়াও, এ উপ-কথা থেকেই আঙ্গুর ফল টক প্রবাদ-প্রবচনটি উদ্ভূত হয়েছে।

রাজহাঁস ও সোনার ডিম উপ-কথায় ব্যক্তি কর্তৃক রাজহাঁস হত্যার বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। প্রতিদিন সকালে এক ব্যক্তির রাজহাঁস একটি করে সোনার ডিম পাড়ে। গৃহকর্তা ডিমগুলো বিক্রয় করে ধনী হতে থাকে। যতই সে ধনী হয়, ততোই সে লোভী হতে থাকে। একবারে সকল ডিম সংগ্রহের লোভে রাজহাঁসটিকে হত্যা করে। কিন্তু সে রাজহাঁসের মধ্যে কোন ডিমই খুঁজে পায়নি।

এছাড়া, কচ্ছপ ও খরগোশের উপ-কথাটি বিশ্বে অন্যতম উপ-কথা হিসেবে পরিচিত।

এসপের উপ-কথাগুলো আজো নৈতিক শিক্ষা প্রদান করে থাকে। বিভিন্ন বিনোদনধর্মী ব্যবস্থা বিশেষতঃ শিশুদের খেলাধূলায় ও কার্টুনের বিষয়বস্তু হিসেবে এ উপ-কথাগুলো প্রয়োগ করা হয়। এসপ অত্যন্ত প্রতিভাবাপন্ন ব্যক্তি হিসেবে তাঁর এ সকল উপকথাগুলোকে উপস্থাপন করেছেন। এগুলোর মাধ্যমে তিনি অনেকগুলো স্মরণীয় উদাহরণের স্বাক্ষর রেখেছেন যাতে তাঁর নাম স্থান, কাল, পাত্রভেদে স্বর্ণালী অক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে। পরবর্তীকালের লেখকগণ তাঁর এ সকল উপ-কথাগুলো সংগ্রহ করে বিশ্বসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে রেখে গেছেন যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার। এ সকল উপকথাগুলোই পাশ্চাত্য সাহিত্য ও পল্লীসাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।

এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান; জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে। চলে যেতে হবে আমাদের। চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি— নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *