বেশিরভাগ শিশুই কমবেশি দুর্ঘটনার শিকার হয় এবং আঘাত পায়। এগুলো সাধারনত ছোটখাটো আঘাত হয়, তবে বড় দুর্ঘটনা ঘটলে বা আঘাত গুরুতর হলে কি করা উচিত জেনে রাখা ভাল। একদম সাধারন প্রাথমিক চিকিৎসাগুলো জেনে নিন, যদি জানা থাকে তাহলে আবার একবার পড়ে নিন।
যদি দুর্ঘটনা ঘটে
কখন অ্যাম্বুলেন্স ডাকা উচিত আর কখন বাচ্চাকে নিজেই হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়া উচিত তা ঠিক করা কঠিন। নিচের নির্দেশনাগুলো মেনে চলুনঃ
কখন আপনার শিশুর জন্য অ্যাম্বুলেন্স ডাকবেন
- যদি সে নিঃশ্বাস নেয়া বন্ধ করে দেয়
- যদি তার শ্বাস নিতে কষ্ট হয় (শ্বাস নেয়ার সময় পাঁজরের নিচের অংশ ভিতরের দিকে ঢুকে গেলে)
- যদি শিশু অজ্ঞান হয়ে যায় বা তার চারপাশে কি হচ্ছে সে তা বুঝতে না পারে।
- যদি তার ঘুম ভাঙ্গানো না যায়
- যদি আপনার বাচ্চা প্রথমবারের মত অজ্ঞান হয় (এমনকি এরপর তার জ্ঞান ফিরে আসলেও)
নিচে উল্লেখ করা অবস্থা হলে বাচ্চাকে আপনিই ইমারজেন্সিতে নিয়ে যানঃ
- জ্বর থাকলে এবং প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন জাতীয় ঔষধ খাওয়ানোর পরও কাজ না হলে
- শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা হলে (অতি দ্রুত শ্বাস নিলে বা বেশি হাঁপালে)
- শিশুর পেটে তীব্র ব্যাথা হলে
- শিশুর শরীরে কোথায় কেটে গেলে যদি রক্ত পড়া বন্ধ না হয় বা কাটা জায়গা যদি বড় হয়।
- যদি হাতে বা পায়ে ব্যাথা পাওয়ার পর, সেটি আর ব্যবহার করতে না পারে
- যদি কোন ট্যাবলেট বা বিষাক্ত কিছু গিলে ফেলে
নাক বা কানের ভিতর কিছু গেলে
বাচ্চার নাক বা কানের ভিতর কোন কিছু ঢুকে আটকে গেলে সেখানে হাত দেবেন না। আপনি সেটা বের করতে গিয়ে আরও ভেতরে ঠেলে দিতে পারেন। বাচ্চাকে সবচেয়ে কাছের হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে নিয়ে যান। যদি নাকে কিছু ঢুকে যাওয়ার কারনে আপনার বাচ্চা নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে না পারে তাহলে তাকে মুখ দিয়ে কিভাবে নিঃশ্বাস নিতে হয় তা দেখিয়ে দিন।
কেটে গেলে
যদি প্রচুর রক্তপাত হয় তাহলে তোয়ালে বা কোন পরিস্কার কাপড় দিয়ে কাটা জায়গাটা শক্ত করে চেপে ধরুন। যদি কাপড় না থাকে তাহলে হাতের আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরুন। যতক্ষণ না রক্ত পড়া বন্ধ হয় ততক্ষন চেপে ধরে থাকুন। রক্ত পড়া বন্ধ হতে ১০ মিনিট বা তারও বেশি সময় লাগতে পারে। ফিতা বা দড়ি জাতীয় কোন কিছু দিয়ে ওই অংশটি এমনভাবে বাঁধবেন না যাতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
সম্ভব হলে আহত অঙ্গটি উপরের দিকে ধরে রাখুন। এতে রক্ত পড়া কমে যাবে। যদি ওই অঙ্গের কোন ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে এমনটি করবেন না। পরিস্কার ব্যান্ডেজের কাপড় থাকলে তা দিয়ে ক্ষত জায়গাটা ঢেকে দিন। যদি ব্যান্ডেজ রক্তে ভিজে যায় তাহলে সেটি না সরিয়ে তার উপর আরও ব্যান্ডেজ বা তুলা দিয়ে চাপা দিন।
গুরুতর রকমের রক্তক্ষরণ সাধারনত কম হয়। হয়ত অ্যাম্বুলেন্স ডাকার দরকার পড়বে না, তবে রক্ত পড়া বন্ধ না হলে বা কাটা জায়গা বড় হলে বাচ্চাকে হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে নিয়ে যান।
পুড়ে গেলে বা ছ্যাকা লাগলে
পুড়ে যাওয়া বা ছ্যাকা লাগা স্থানটি কলের পানি ছেড়ে দিয়ে তার নিচে ধরে রাখুন যেন পোড়া জায়গার তাপমাত্রা কমে যায়। দশ মিনিটের বেশি এভাবে রাখবেন না, এতে বাচ্চার ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। যদি এভাবে পানিতে ধরে রাখা না যায়, তাহলে পোড়া জায়গাটা ঠাণ্ডা পানি, দুধ বা যে কোন ধরনের পানীতে ডুবিয়ে রাখুন।
পরিস্কার এবং আঁশবিহীন কাপড় বা লিনেনের তোয়ালে বা খাবার মুড়ে রাখার প্লাস্টিক দিয়ে পোড়া জায়গাটা ঢেকে রাখুন। এতে সংক্রমণের ঝুকে কমে যাবে। যদি আপনার বাচ্চার গায়ের জামা ওই জায়গার সাথে আটকে যায় তাহলে তা ছুটানোর চেষ্টা করবেন না।
পুড়ে গেলে বা ছ্যাকা লাগলে সেখানে মাখন, টুথপেস্ট, তেল বা মলম লাগাবেন না, কারন পোড়া জায়গাটার চিকিৎসা করতে হলে সেগুলো আবার পরিস্কার করতে হবে। কতটা পুড়ে গেছে তা দেখে বাচ্চাকে ডাক্তারের কাছে কিংবা ইমারজেন্সিতে নিয়ে যান।
ফোস্কা স্বাভাবিকভাবেই ফেটে যাওয়ার কথা। ফোস্কার নিচের অংশের সুরক্ষার জন্য ড্রেসিং দরকার হবে। এব্যাপারে ফার্মাসিস্ট বা কর্তব্যরত নার্সের সহযোগিতা বা উপদেশ নিন।
শিশু বিষাক্ত কিছু গিলে ফেললে
যদি মনে হয় যে আপনার বাচ্চা কোন ঔষধ বা ট্যাবলেট গিলে ফেলেছে, তাহলে
- আপনি পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে থাকলে এক বা দুই মিনিট আপনার সেই ঔষধটির খোঁজ করুন, হয়ত সেটি গড়িয়ে কোন চেয়ারের নিচে চলে গিয়েছে।
- যদি তারপরও আপনার মনে হয় যে সে কোন কিছু গিলে ফেলেছে তাহলে তাকে সাথে সাথে সবচেয়ে কাছের হাসপাতাল বা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।
- ট্যাবলেটের পুরো পাতা বা বোতল সঙ্গে নিয়ে যান যেন ডাক্তার সেটির গায়ের নির্দেশনাগুলো পড়তে পারে, এবং বাচ্চা কি পরিমানে সেটি খেয়েছে তা বুঝতে পারে।
- বাচ্চার দিকে সবসময় খেয়াল রাখুন এবং কৃত্রিমভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস চালুর প্রক্রিয়া (resuscitation sequence) শুরুর জন্য প্রস্তুত থাকুন।
- প্রয়োজনে বাচ্চা যেটি গিলে ফেলেছে তার নাম একটা কিছুতে লিখে নিন, যেন ডাক্তারকে বলতে পারেন।
- বাচ্চাকে বমি করানোর জন্য লবনপানি খাওয়ানো বা এরকম অন্য কোন কিছু করবেন না।
- যদি মনে হয় আপনার শিশু ঘর বা বাগানের কাজে ব্যবহৃত কোন রাসায়নিক বা কীটনাশক গিলে ফেলেছে, তাহলেঃ
- বাচ্চাকে যথাসম্ভব শান্ত রাখুন (আপনি নিজে মাথা ঠাণ্ডা করে রাখলে এটা করা সহজ হবে)। এরপর দ্রুত বাচ্চাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন।
- প্রয়োজনে বাচ্চা যেটি গিলে ফেলেছে তার নাম একটা কিছুতে লিখে নিন, যেন ডাক্তারকে বলতে পারেন।
- যদি আপনার বাচ্চা ব্যাথা অনুভব করে বা তার মুখের চারপাশে কোন দাগ, ক্ষত বা ফোস্কা দেখতে পান তাহলে সম্ভবত সে ক্ষয়কারক (corrosive) কিছু গিলে ফেলেছে। তাকে আস্তে আস্তে চুমুক দিয়ে খাওয়ার জন্য দুধ বা পানি দিন, এতে ব্যাথা কমবে, এবং দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান।
শক
কোন দুর্ঘটনা ঘটার পর আপনার শিশুর চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেলে, অথবা সে অসুস্থ বোধ করলে তাকে শুইয়ে দিন। চাদরজাতীয় কিছু তার গায়ে দিয়ে দিন, কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, তার যেন বেশি গরম না লাগে। যদি তার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয় তাহলে মাথা ঝুঁকিয়ে রাখতে বলুন, এবং সম্ভব হলে শুইয়ে দিন। দুর্বল ভাব কিছুক্ষনের মধ্যে কেটে যাওয়ার কথা।
হঠাত জ্ঞানহীন হয়ে যাওয়া বা খিঁচুনি হওয়া
জ্বরের সময় কাঁপুনি বা খিঁচুনি হলে, দেখতে ভীতিকর মনে হলেও তিন বছরের কম বয়সি বাচ্চাদের জন্য এটা খুব স্বাভাবিক। যদিও অনেক কারনেই বাচ্চার খিঁচুনি হতে পারে, তবে অতিরিক্ত জ্বর এর সবেচেয়ে সাধারন কারন। এসময় আপনার শিশুর বেশি কষ্ট হচ্ছে মনে হলে তাকে প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন (ibuprofen) জাতীয় ঔষধ দিন।
এ বিষয়ে আরো তথ্যের জন্য দেখুনঃ
আপনার শিশু অচেতন হয়ে পড়লে তার হাত-পা হঠাৎ শক্ত হয়ে গিয়ে সে নীলবর্ণ ধারন করতে পারে। এসময় তাদের চোখ খোলা কিন্তু স্থির হয়ে থাকতে পারে অথবা তার চোখ উলটিয়ে ও হাত-পা অস্বাভাবিক রকমভাবে বেঁকে গিয়ে কাঁপুনি হতে পারে। অথবা সে অস্বাভাবিক রকম নেতিয়ে পড়তে পারে। এরকম হলে নিচের নির্দেশনাগুলো আপনার কাজে লাগবেঃ
- আপনি শান্ত থাকুন।
- বাচ্চাকে কাত করে শুইয়ে দিন, যেন তার বমি না হয় বা তার শ্বাসনালী বন্ধ না হয়ে যায়। তার মুখের ভিতর কিছু দেবেন না। যদি মনে হয় যে তার গলায় খাবার বা অন্য কিছু আটকে গেছে তাহলে সেটি বের করার চেষ্টা করুন।
- বাচ্চার শরীর থেকে সব জামাকাপড় খুলে ফেলুন, তবে খেয়াল রাখতে হবে তার যেন আবার ঠাণ্ডা না লেগে যায়।
- বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জ্ঞানহীন অবস্থা তিন মিনিটের বেশি থাকে না। জ্ঞান ফিরে আসলে আপনার বাচ্চাকে আশ্বস্ত করুন, তার যেভাবে আরাম লাগে সেভাবে রাখুন এবং ডাক্তার ডাকুন।
- যদি জ্ঞানহীন অবস্থা তিন মিনিটের ভেতর না কাটে তাহলে অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন। যদি প্রথমবারের মত আপনার বাচ্চার এরকম হয় তাহলে তার জ্ঞান ফিরে আসলেও তাকে চেকআপের জন্য নিয়ে নিকটস্থ হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে নিয়ে যান।
- এসময় অতিরিক্ত ভয় পাবেন না। ৩০ মিনিটের বেশি জ্ঞানশূন্য না থাকলে মস্তিস্কের কোনরকম ক্ষতি হওয়ার কথা না।
- যদি এ রকম অবস্থা আপনার শিশুর প্রথমবারের মত নাও হয়, তবু এরকম হলে আপনার ডক্তারকে তার জ্ঞানহীন হওয়ার বিষয়টি জানিয়ে রাখুন।
- তিন বছর বয়সের পর জ্বরের সময় খিঁচুনি হয়াটা কমে যায় এবং পাঁচ বছর বয়সের পর শিশুদের মধ্যে এটি প্রায় দেখাই যায় না। জ্বরের ঘোরে খিঁচুনি হওয়ার সাথে মৃগীরোগের কোন সম্পর্ক নেই।
বৈদ্যুতিক শক
বাচ্চার বৈদ্যুতিক শক লাগলে তাকে ধরতে যাওয়ার আগে বৈদ্যুতিক সংযোগের সুইচ বন্ধ করে নিন। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে তাকে কাঠ বা প্লাস্টিকের কোন কিছু (যেমন ঝাড়ুর হাতল) দিয়ে ঠেলে বৈদ্যুতিক তারটি থেকে ছুটিয়ে দিন। এরপর তাকে জাগানোর জন্য আস্তে আস্তে তার পায়ে ঘাড়ে চাপড় দিয়ে তাকে ডাকতে থাকুন। যদি এতে বাচ্চার সাড়া না পান তাহলে কৃত্রিমভাবে তার শ্বাসপ্রশ্বাস চালু করার প্রক্রিয়া (resuscitation sequence) শুরু করুন।
হাড় ভেঙ্গে গেলে
যদি মনে হয় আপনার বাচ্চার ঘাড়ে বা মেরুদণ্ডে চোট লেগেছে, তাহলে অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন। তাকে নিয়ে কোথাও নড়াচড়া করবেন না। অযথা নাড়াচাড়া করার ফলে সে প্যারালাইসিস বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে। যদি আপনার শিশুর কোন হাত বা পা ফুলে যায় ও ব্যাথা করে এবং বেকায়দাভাবে ঝুলে থাকে তাহলে হয়ত সেটির কোন হাড় ভেঙ্গে গেছে।
যদি আপনার শিশুকে এমন অবস্থায় সহজে বা ব্যাথা না দিয়ে নড়াতে না পারেন তাহলে অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন। বাচ্চাকে একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেয়ার সময় খুব আস্তে চলুন। এসময় ব্যাথা পাওয়া স্থানটির উপরে এবং নিচে হাত দিয়ে সেটিকে স্থির করে ধরে রাখুন (প্রয়োজনে কাপড় বা কম্বল দিয়ে চাপ দিয়ে ধরুন)। বাচ্চা যে ভঙ্গিতে থাকলে ব্যথা কম থাকে, সে অবস্থায় রাখার চেষ্টা করুন ও হাসপাতালে নিয়ে যান।
যদি মনে হয় যে আপনার বাচ্চার কষ্ট হচ্ছে তাহলে তাকে (এমনকি হাসপাতালে যাওয়ার রাস্তায় থাকলেও) ব্যাথানাশক ঔষধ (painkiller) খাইয়ে দিন। ঔষধের গায়ে লেখা নির্দেশিকা পড়ে কতটুকু খাওয়াবেন তা ঠিক করুন।
Credit: https://www.maya.com.bd/content/web/wp/1561/